ধর্মান্তিত ব্যাক্তির উত্তরাধিকার সম্পত্তির আইনগত অধিকার । ধর্মান্তরিত উত্তরাধিকার কাকে বলে ।

ধর্মান্তিত ব্যাক্তির উত্তরাধিকার সম্পত্তির আইনগত অধিকার । ধর্মান্তরিত উত্তরাধিকার কাকে বলে ।

ধর্মান্তিত ব্যাক্তির উত্তরাধিকার সম্পত্তির আইনগত অধিকার ।  ধর্মান্তরিত উত্তরাধিকার কাকে বলে । মুসলিম উত্তরাধিকার আইন ১৯৬১ ।  সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন বাংলাদেশ । হিন্দু উত্তরাধিকার । মুসলিম ফারায়েজ আইন । ধর্মান্তরিত মুসলিম ।
ধর্মান্তিত ব্যাক্তির উত্তরাধিকার সম্পত্তির আইনগত অধিকার


ধর্মান্তিত ব্যাক্তির উত্তরাধিকার সম্পত্তির আইনগত অধিকার । 
ধর্মান্তরিত উত্তরাধিকার কাকে বলে । মুসলিম উত্তরাধিকার আইন ১৯৬১ ।  সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন বাংলাদেশ । হিন্দু উত্তরাধিকার । মুসলিম ফারায়েজ আইন । ধর্মান্তরিত মুসলিম ।

 

ধর্মান্তিত ব্যাক্তির উত্তরাধিকার সম্পত্তি এর আইনগত অধিকার?

সভ্যতার সূচনালগ্ন হইতে সমাজ কাঠামোর অন্যতম অনুসঙ্গ হইল ধর্ম, আর এই ধর্ম কেবল আমাদের বিশ্বাসে নয়, এর শিকড় এবং পরিধি আরো গভীরেব্যক্তি বা পরিবার বা সমাজ নিয়ন্ত্রনের অন্যতম হাতিয়ার ধর্ম খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে প্রণীত হাম্বুরাবী আইন হইতে শুরু করিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী যে, শাসন কাঠামো গড়িয়া উঠিয়াছে প্রত্যেকটি জায়গায় রহিয়াছে ধর্মের ব্যাপক প্রভাব

ধর্মধর্মান্তরের ইতিহাস সু-প্রাচীন, ধর্মান্তরিত ব্যক্তির প্রতি প্রত্যেকটি ধর্মপ্রত্যেক সমাজের অবস্থানই অভিন্ন। ধর্মধর্মান্তরের কালানুক্রিমক পর্যায় নয়, আমার আজকের আলোচ্য হিন্দু হইতে ধর্মান্তরিত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকার-

সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত মোকদ্দমা দেওয়ানি প্রকৃতির মোকদ্দমা। দেওয়ানি মোকদ্দমা সমূহের  বিচারকার্য পরিচালনার  জন্য  ১৮৮৭ সালে ১১মার্চ প্রণয়ন করা হয় The Civil Courts Act-1887 আইনের ৩৭ ধারায় কতিপয়  বিষয়ে রাষ্ট্রীয় আইন নয়, হিন্দু বা মুসলিমদের ধর্মীয় আইনের বিধানকে সংরক্ষণ করা হইয়াছে ৩৭ ধারায় বলা হইয়াছে যে,  কোন মামলা বা কার্যধারায় দেওয়ানি আদালত কতৃক উত্তরাধিকার ওয়ারিশী, বিবাহ  বা ব্যক্তিগত ধর্মীয় আচরণ বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত বিষয়ে পক্ষগন হিন্দু হলে হিন্দু আইন এবং মুসলিম হলে মুসলিম আইন প্রযোজ্য  হবে

হিন্দু এবং মুসলিম উভয় আইন মোতাবেক সম্পত্তির উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে অভিন্ন নীতি হইলো কেউ যদি ধর্মান্তরিত হয় তবে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি যেধর্মে ধর্মান্তরিত হইবে তাহার ক্ষেত্রে সেই আইন প্রযোজ্য হইবে এবং ব্যক্তি তার পিতামাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার হইতে বঞ্চিত হইবে। এখন প্রশ্ন হলো উভয় পার্সোনাল আইন মোতাবেক যদি ধর্মান্তরিত ব্যক্তি উত্তরাধিকার হইতে বঞ্চিত হয় তবে বিভ্রান্তিটা কোথায়?

বিভ্রান্তিটা সৃষ্টি করেছে ১৮৫০ সালে প্রণীত Cast Disabilities Removal Act,1850 মুসলিম আইন এর উপর বাজারে যত বই আছে কোন বইতে এটা লিখে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়নি যে, ১৮৫০ সালের আইন প্রণয়নের পর পূর্বে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি উত্তরাধিকার বঞ্চিত হলেও এখন কোনো মুসলিম যদি অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হয় তবে তার মা বাবার সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত হয় না, কিন্ত হিন্দু আইনের ওপর বাজারে যত বই আছে প্রায় প্রত্যেকটা বইয়ের ভাষ্য যে, পূর্বে উত্তরাধিকার বঞ্চিত হলেও ১৮৫০ সালের Cast disabilities Removal Act প্রণয়নের পর আর বঞ্চিত হয়না। মাত্র দু একটা বইয়ে হয়তো ব্যতিক্রম রয়েছে। তাই বিভ্রান্তির যথেষ্ট সুযোগ রহিয়াছে আমি এই লেখায় হিন্দু শাস্ত্রের বিধান, মুসলিম ধর্মের বিধান, ১৮৫০ সালের আইনের প্রয়োগবর্তমানে এই আইনের প্রয়োগের ক্রমানুযায়ী আলোচনার মাধ্যমে বিভ্রান্তিটা নিরসনে চেষ্টা করিব;

হিন্দু আইনে দুটি মতবাদ রয়েছে, দায়ভাগমিতক্ষরা বাংলাদেশপশ্চিমবঙ্গের হিন্দুগন দায়ভাগ মতবাদ অনুসারী দায়ভাগ মতবাদের অন্যতম উৎস মনু স্মৃতিযাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি এবার দেখা যাক তাদের মতে কারা হিন্দু সম্পত্তির উত্তরাধিকার হইতে বঞ্চিত হইবেন-

মনু বলেছেন-“ক্লীব বা জাতিভ্রষ্ট বা  ধর্মান্তরিত বা জন্মান্ধ বা জন্মবধির বা জন্মউন্মাদগ্রস্ত ব্যক্তিগন সম্পত্তির অংশ হইতে বঞ্চিত হইবেন।

যাজ্ঞ বল্ক্ বলেছেন, “জাতিভ্রষ্ট ব্যক্তি বা ক্লীব বা উন্মাদগ্রস্ত বা অন্ধ বা দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পত্তির উত্তরাধিকার হইতে বঞ্চিত হইবেন।

সুতরাং, হইতে দেখা যাইতেছে যে, ধর্মান্তরিত ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকার হইতে বঞ্চিত হওয়া বিষয়ে সকল শাস্ত্রকারই একমত। ধর্মান্তর বাদে অন্য যে সকল কারনে হিন্দু আইনে উত্তরাধিকার বঞ্চিত হইবার কথা বলা হইয়াছে পরবর্তীতে  বিভিন্ন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই সকল অ-যোগ্যতা দূর করা হইয়াছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১৯৫৬ সালে উত্তরাধিকার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নারীকে পুরুষ এর সমান সম্পত্তির অংশীদার করা হইয়াছে, যদিও এই আইনসহ ১৯৪৭ সালের পরে ভারতে আনা আইনসমূহ বাংলাদেশে জন্য প্রযোজ্য নয়

মুসলিম আইনে ধর্মান্তরিত ব্যক্তির অবস্থান:

হিন্দু আইনের মতো একজন মুসলিম যদি অন্য কোন ধর্মে ধর্মান্তরিত হন তাহলে তিনি যাদের সম্পত্তিতে ওয়ারিশ হতেন  সেখান হতে বঞ্চিত হন। মুসলিমদের কিছু বিষয়ে ধর্মীয় বিধানকে সুরক্ষা দেবার জন্য ১৯৩৭ সালে The Muslim Personal Shariat Application Act, 1937 প্রণীত হয়। আইনে যে ১০ টি ক্ষেত্রে শরীয়াহ আইন সংরক্ষণ করে তার মধ্যে অন্যতম একটি বিষয় হলো ফারায়েজ বা উত্তরাধিকার

সহীহ বুখারী শরীফে উত্তরাধিকার হইতে বঞ্চিত করণ বিষয়ে বলা হইয়াছে যে, একজন মুসলমান কোন অ-মুসলিম এর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হবেন না বা একজন মুসলিমের সম্পত্তিতে কোন অ-মুসলিম উত্তরাধিকারী হবেন না। ধর্মান্তরিত হলে ব্যক্তি মুসলিম আত্মীয়র সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত হইবে, তবে মৃত্যুর পূর্বে আবার মুসলমান হইলে সে উত্তরাধিকারী হইতে পারিবে

Cast Disabilities Removal Act -1850  ও এর ফলাফল:

১৮৫০ সাল এর এই আইনটিকে ধর্মীয় স্বাধীনতার আইনও বলা হয়, এই আইনটি কেবল হিন্দু উত্তরাধিকারের  প্রতিষ্ঠিত নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনিয়াছে তাহা নয়, এটি মুসলিম উত্তরাধিকার সংক্রান্ত নীতিতেও মৌলিক পরিবর্তন নিয়া আসিয়াছে, আইনে Caste শব্দটি থাকিলেও ভাবার সুযোগ নেই যে, এইটা শুধু হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন বর্ণ প্রথা রহিয়াছে তাহতে উদ্ভূত সমস্যা নিরসনকল্পে করা হইয়াছে বরং এই আইনে ধর্মান্তরিত বা বর্ণচ্যুত উভয় ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষিত করা হইয়াছে ১৮৫০ সালের এই আইনটি মূলত মৌলিক বা নতুন আইন নয়, ১৮৩২ সালের যে Bengal Presidency Regulations প্রণীত হয় ১৮৫০ সালের আইনটি এটির বর্ধিত সংস্করণ মাত্র। আইনে বলা হয় হিন্দু বা মুসলিম কোন ধর্মান্তরিত ব্যক্তি তার ধর্ম এবং প্রথা অনুসারে যে সকল অধিকার হতে বঞ্চিত হতো আইন কার্যকরের পর আর বঞ্চিত হবেন না, পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসকগণ আইনটি পুরো ভারত বর্ষে  প্রয়োগের চিন্তা করেন এবং একই সাথে ভারতের হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন caste বা Sub-caste হইতে কোন ব্যক্তি চ্যুত হইবার ফলে যে অধিকার সমূহ হারাতো তাদের অধিকার সমূহ  সুরক্ষা দেবার উদ্যোগ গ্রহন করে

Cast Disabilities Removal Act-1850 আইনে টি প্রস্তাবনা এবং মাত্র টি ধারা আছে, যেটা পড়লে আপনি পুরোপুরি নিশ্চিৎ হয়ে যাইবেন যে,  এই আইনটি  কেবল মাত্র হিন্দুদের বর্ণচ্যুতি দূর করার জন্য নয় বরং ধর্ম বা বর্ণ উভয় চ্যুতির ফলে বঞ্চিতদের অধিকার রক্ষায় করা হইয়াছে এই আইনে change of Religion শব্দটি ব্যবহার করা হইয়াছে, কোন নির্দিষ্ট Religion নয়। ১৮৩২ সালের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি  রেগুলেশন কেবল হিন্দু বা মুসলিমদের ধর্ম পরিবর্তন এর বিষয় বলা হইলেও আইনে Religion শব্দ ব্যবহার করে সকল ধর্ম হইতে ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা দেওয়া হইয়াছে এই আইন প্রয়োগের ফলে হিন্দু বা মুসলিম বা বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান বা জৈন বা শিখ প্রত্যেকেই ধর্মান্তরিত হলেও তার বাবা ও মায়ের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হইবার অধিকার লাভ করেছিল

১৮৫০ সালের আইনের বর্তমান প্রয়োগ:

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারী হয়, এই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আমাদের প্রথম অন্তবর্তীকালীন সংবিধান এবং এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসন হইতে শুরু করে পাকিস্তান ভূ-খন্ডে যতগুলো আইন প্রচলিত ছিল তা ২৬ শে মার্চ হইতে Retrospective Effect দিয়ে বৈধতা দেওয়া হয়। ফলে ১৮৫০ সালের আইন বাংলাদেশে কার্যকর হয়, কিন্ত এই কার্যকারিতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি বেশি দিন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার বাংলাদেশ স্বাধীনের পূর্বের প্রচলিত আইনসমূহ পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৩ সালে Bangladesh Laws Revision And Declaration Act, 1973  প্রণীত হয়। আইনে টি schedule বা তফশীল আছে, প্রথম schedule বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে প্রচলিত কোন কোন আইনগুলো বাতিল করা হইলো তার তালিকা ও এর দ্বিতীয় schedule কোন কোন আইনগুলো গ্রহন করা হইলোকোন সংশোধনী থাকিলে তা উল্লেখ করা হইয়াছে

এই আইনের প্রথম শিডিউলের যে বাতিলকৃত আইনসমূহের তালিকা দেওয়া হয়েছে তার নম্বর ক্রমে The Cast disabilities Removal Act, 1850 সালের আইনটি রয়েছে। এই আইনটি যে কেবল বাংলাদেশে  বাতিল তা নয় ভারতেও এই আইনটি ২০১৭ সালে বাতিল করিয়া দেওয়া হইয়াছে।বাংলাদেশ সরকার সুচিন্তিত ভাবেই ১৯৭৩ আইনটিকে বৈধতা দেয়নি। বৈধতা দিলে কেবল ধর্মান্তরিত হিন্দু ব্যক্তি যে তার পিতা-মাতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হতো তা নয়, একজন মুসলিম যদি অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হতো তারপরও তার মা-বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হইতো যা কোরআন এবং হাদিসের বিধান বিরোধী হইতো

সুতরাং,১৯৭৩ সালের Bangladesh Laws Revision and declaration আইনের পর হইতে ১৮৫০ সালের Cast Removal  and disabilities Act এর  কোন প্রয়োগ  নেই, ফলে পূর্বের যে পার্সোনাল আইন তা বহাল থাকছে, হিন্দু বা মুসলিম যেই হোক ধর্মান্তরিত হলে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছে। ১৮৫০ সালের যে আইন ১৯৭৩ বাতিল করে দিয়েছে বাতিলের ৪৮ বছর পরও সেই আইনের রেফারেন্স দিয়ে হিন্দু আইনের ওপর বাজারে প্রচলিত সিংহভাগ বই আইন শিক্ষার্থীদের মিসলিড বা বিভ্রান্ত করছে যা দু:খজনক। আইনকে সম্যকভাবে সর্বশেষ সংশোধনীসহ পাঠকদের জানানোর দায়বদ্ধতা লেখকের রয়েছে

Post a Comment

0 Comments